ওবায়দা বেগম : লাইব্রেরি ও লাইব্রেরিয়ানদের সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। আমি আমার নিজস্ব চেতনা থেকে কিছু লিখার চেষ্টা করছি। সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের বা ভাব বিনিময়ের নানা মাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ভাব বিনিময় এবং যোগাযোগের এমনই একটি অসাধারণ অর্জন হলো গ্রন্থাগার। জ্ঞান সৃষ্টি, সেই জ্ঞানের শ্রেনীবদ্ধ ও কাঠামোগত সংরক্ষণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের বিস্তৃতি এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে গ্রন্থাগার। আর এই জ্ঞানের সুষ্ঠ সংরক্ষক, ব্যবস্থাপক এবং সভ্যতার বিকাশে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার মূল ভূমিকায় রয়েছেন লাইব্রেরিয়ান গণ।
বর্তমানে লাইব্রেরিগুলি বিভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সনাতন লাইব্রেরি, ডিজিটাল লাইব্রেরি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে। ডিজিটাল লাইব্রেরিগুলি প্রযুক্তির সকল সুবিধা গ্রহন করে আধুনিক তথ্যসেবা প্রদান করছে। অন্যদিকে বেশ কিছু লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ানগণ ডিজিটাল প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষতার অধিকারী হওয়া সত্বেও সেখানে সনাতন পদ্ধতিই পরিচালিত হচ্ছে। কারণ সেসব লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল লাইব্রেরির সপক্ষে নন। তার কারণ বাজেট সমস্যা এবং সর্বপরি ডিজিটাল লাইব্রেরি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
এবার নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে আসা যাক। সরকারী, বেসরকারী এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিয়ানদের পদ ও গ্রেড এর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে অনেক। একই পদে বিভিন্ন গ্রেড এ লাইব্রেরিয়ানদের নিয়োগ দিচ্ছে। কিছু স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিয়ানদের গ্রেট গ্রেড প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মকর্তাদের (বিজ্ঞানী) সাথে ৫ম গ্রেডের পর এসে ব্যবধান হয়ে গিয়েছে যদিও উভয় পদ পদমর্যার দিক থেকে সমান। গ্রেড নিয়ে অসামঞ্জস্যতা দূর করার জন্য একই মন্ত্রনালয়ের লাইব্রেরিগুলিতে যোগাযোগ করা হলে জানা গেল কোনখানেই লাইব্রেরিয়ানের উপরে আর কোন পদ নেই। বি সি এস আই আর এ মুখ্য লাইব্রেরিয়ানের ৪র্থ গ্রেডে বেতন দেয়া হয় কিন্তু তার কোন ডক্যুমেন্ট নেই, যেটি যে কোন সময় বাতিল হয়ে যেতে পারে। বি আই ডি এস এ চিফ লাইব্রেরিয়ানের গ্রেড ৪র্থ, যেটা হওয়া উচিত ছিল ৩য় গ্রেডের। আর এভাবেই আমরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এবং মর্যাদার দিক থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। কিন্তু লাইব্রেরিয়ানগণ যোগ্যতায় এবং আধুনিক লাইব্রেরি পরিচালনা ও তথ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
বাংলাদেশ গ্রন্থাাগার সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ গ্রন্থাগারিকদের দাবী দাওয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি করছেন এবং মন্ত্রনালয়ের সাথে যোগাযোগ করে সমস্যার সমাধানের চেস্টা করছেন। সেখানে পুরো গ্রন্থাগার পেশাজীবী (প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার এর গ্রন্থাগারিক) দের দাবী দাওয়া নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। আজ সরকারী এবং স্বায়ত্বস্বাশিত গ্রন্থাগারগুলো অনলাইন পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হতে পারছে না। সনাতন পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। সমিতির উচিত পেশার উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে জানানো যে, সকল গ্রন্থাগারকে ডিজিটালাইজেশন করার ব্যবস্থা করা হোক। মূল সমস্যা হলো কিছু লাইব্রেরি (কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিগুলো) ডিজিটালাইজড অন্যদিকে অন্যান্য লাইব্রেরিগুলো খুব খারাপ অবস্থানে আছে। আর অন্যান্য লাইব্রেরি নিয়ে সরকার এবং সমিতির পক্ষে কোন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না। সব লাইব্রেরির মধ্যে সমন্বয়তা আনা গেলে হয়ত সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
সব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উপর ভরসা করে লাইব্রেরির কখনও উন্নতি হবে না, ডিজিটাল লাইব্রেরি হিসেবে পরিণত হতে পারবে না। পেশার উন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে ডিজিটাইজেশন এর পক্ষে কাজ করতে হবে। আজ লাইব্রেরিয়ানরা এত অবহেলিত কেন? লাইব্রেরিয়ানদের কর্মদক্ষতা এবং ডিজিটাল জ্ঞান সম্পর্কিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। ফলে আমাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ অবহিত নন। অনেক কর্মকর্তা জানেনও না যে লাইব্রেরি পেশাজীবীরা বড় একটি ডিগ্রী নিয়ে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। প্রশাসন এবং লাইব্রেরির মধ্যে অনেক পার্থক্য। প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে লাইব্রেরিয়ানদের মিলিয়ে প্রাপ্য মর্যাদা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লাইব্রেরিয়ানরা তথ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পারদর্শী। তারা সব সময় প্রযুক্তি নির্ভর কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পরিশেষে সবক্ষেত্রে লাইব্রেরিয়ানদের মর্যাদা, পদন্নোতি, স্কেল জটিলতা এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হোক এবং সর্বপরি ডিজিটাল বাংলাদেশের হাতিয়ার হিসেবে সব শ্রেনীর লাইব্রেরিগুলি ডিজিটাল লাইব্রেরি হিসেবে রূপন্তিরিত হোক সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক পরিচিতিঃ ওবায়দা বেগম
মুখ্য লাইব্রেরিয়ান,
পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা।
4 Comments
খুব সুন্দর করে বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু পরিতাপের বিষয় তেমন ফল পাচ্ছি না।
সবগুলো পড়লাম, অনেক সুন্দর হয়েছে।
চমৎকার লেখা যা বাস্তবায় করা উচিত।
সহকারি লাইব্রেরিয়ান পদে নতুন করে নিয়োগের সম্ভাবনা আছে কি জানতে চাই